“বিশ্বের যা কিছু মহান/সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
লাবণ্যময়ী, সুন্দরী, সুনয়না অথবা অবলা, অসহায়, পরনির্ভর উপমা থেকে মুক্ত করে, নারীকে তার যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিবেচনা করে যেভাবে মর্যাদা দেওয়া যায়, সে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সভ্যতা গড়ার কাজে মানুষের যে অবদান, সে সম্মাননায় পুরুষের সমান ভাগিদার নারী। নারীকে পেছনে ফেলে পুরুষের এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টাটা বরাবরই বৃথা বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ‘জোর যার রাজ্য তার’ নিয়মের যাতাকলে পড়ে এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীরা হচ্ছেন প্রতিনিয়ত অবহেলিত, নিপীড়িত এবং লাঞ্চিত। যুগ যুগ ধরে পুরুষতান্ত্রিক শাসন, ধর্মীয় গোড়ামী এবং সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দী হয়ে নারীকে বরণ করে নিতে হয়েছে অমানসিক কষ্টের জীবন। তাই, নারীমুক্তির জন্য, নারীর প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতকণের লক্ষ্যে প্রতিবছর ৮ই মার্চ পালিত হয় বিশ্ব নারী দিবস।
নারী দিবসের ইতিহাস
আজ যে নারী দিবস পালিত হচ্ছে তা একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এর পিছনে রয়েছে এক প্রগাঢ় ইতিহাস। এটি মূলত ছিলো নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে মজুরি বৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আর কাজের অনিরাপদ পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে আন্দোলনে নামেন এক সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকারি ও শাষক বাহিনীর দমন-পীড়ন ও নির্যাতন। পরে ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে নেতৃত্ব দেন জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন। ক্লারা জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন।
এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন এতে। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চলা আন্দোলন আর সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯১১ সাল থেকে একটি দিন নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়। পরে ১৯১৪ সাল থেকে বেশকয়েকটি দেশে ৮ই মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই নারী দিবস পালন করে আসছে। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিকভাবে নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয় এবং জাতিসংঘ সকল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে যথাযথ উদযাপনের মধ্য দিয়ে নারী দিবস পালনের জন্য আহবান জানান। এই বিশেষ দিনটির প্রথম থিম ছিল “সেলিব্রেটিং দ্য পাস্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং ফর দ্য ফিউচার”, যার অর্থ হলো, “বর্তমানকে উদযাপন এবং ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা তৈরী”।
নারীর অধিকার নিশ্চিতকরণ, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারী মুক্তির লক্ষ্যে যুগের পর যুগ ধরে চলছে বিশ্বের নারী সংগ্রাম। বিশ্ব নারী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়জিত হয় ‘বিশ্ব নারী সম্মেলন’। এই নারী আন্দোলন–সংগঠনের প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের সম্মতিতে গৃহীত হয় ১২টি বিষয় যেগুলোকে ভিত্তি করে পরিচালিত হচ্ছে নারী আন্দোলন-সংগঠনের সংগ্রাম। আলোচ্য ১২টি বিষয় হচ্ছে : শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দারিদ্র্য, সহিংসতা, মানবাধিকার, পরিবেশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারী-পুরুষের সমতা, প্রচারমাধ্যম, তথ্যপ্রযুক্তি, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় আইন, অর্থায়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ।
নারী দিবসের উদ্দেশ্য
সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে যেমন নারীর সুযোগ সুবিধা ও অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে, সেই সাথে পরিবর্তিত হয়েছে এই দিবস পালনের উদ্দেশ্যও। প্রথমদিকে, অর্থাৎ উনিশ শতকে যখন এটি শুরু হয়েছিল, তখন মূলত নারীদের ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জনের উদ্দেশ্যে নারী দিবস পালিত হতো। তারপর যখন ভোটদানের অধিকার নিশ্চিত হলো, নারী দিবস পালনের উদ্দেশ্যেও এলো কিছু পরিবর্তন। বর্তমান সময়ে নারী দিবস উদযাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা বজায় রাখা। আজও পৃথিবীর অনেক জায়গা আছে যেখানে নারীদের পুরুষের সমান অধিকার নেই। যেখানে নারীদের শুধুমাত্র নারী হবার কারণে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দেওয়া হয়না যথাযথ মর্যাদা, স্থান বা স্বীকৃতি। চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও হতে হয় বাধার সম্মুখীন, সকল বাধার আড়ালে পড়ে নারীরা আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও রয়েছে বেশ পিছিয়ে।
বিশ্বের এমন অনেক দেশ আছে যেখানে নারীরা এখনো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো সুযোগ ও অনুপ্রেরণার অভাব। ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ পিছিয়ে পড়া নারীই তাদের ঘরের শেকলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাদের সহ্য করতে হচ্ছে অমানবিক শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা। সমমেধা সম্পন্ন হয়েও পুরুষের সমান সুযোগ, এমনকি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। তাই সমসাময়িক নারী দিবস উদযাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো নারী পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মধ্য দিয়ে নারীত্বের উৎসব পালিত হয়। জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে নারীদের কৃতিত্বকে স্বীকৃতি জানানোর জন্য এই দিনটি পালিত হয়। এই দিনে প্রত্যেক নারী এবং পুরুষকে নারী অধিকার ও লিঙ্গ সমতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা হয়। পাশাপাশি নারীদের সমান অধিকারের লড়াই জোরদার করাও এই দিনটি পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য। পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কিংবা পেশাগত জীবনে নারীদের যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং যেসব ধকল মোকাবিলা করতে হয়, এই বিশেষ দিবস পালনের মধ্য দিয়ে সেও চিত্র সকলের সামনে তুলে ধরা হয়। এতে করে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়
যদিও নারী দিবস পালনের উদ্দেশ্য নারীর জন্য যথাযোগ্য অবস্থান নিশ্চিতকরণ, তবুও প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন ধরনের একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য বিষয়কে লক্ষ্য নিশ্চিত করে উদযাপন করা হয় এই বিশেষ দিন। ২০২২ সালে নারী দিবস পালনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ”নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ”। গঠনগত দিক ও শারীরিক সক্ষমতার দিক বিবেচনা অনুযায়ী, নারী ও পুরুষের স্বাস্থ্যবিধি কিছুক্ষেত্রে আলাদা। সুস্থ ও সক্ষম থাকার জন্য মেনে চলতে হবে যথাযোগ্য স্বাস্থ্যবিধি ও নিয়মাবলী। কিন্তু পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন অসুবিধা, দারিদ্র্য অথবা সংকোচ বহু বছর ধরে মোকাবিলা করে এগিয়ে চলা নারীদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলছে তাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির অভাব। বিশেষত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে নারীদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নুন্যতম স্বাস্থ্য সেবা পাওয়াও খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে। এই ধরনের অসম অবস্থার আসল চিত্র আরও স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায় বর্তমান সমাজের নারী পুরুষের লিঙ্গের আনুপাতিক মূল্যায়নের দিকে দৃষ্টিপাত করলে। তা ই সংকট নিরসনে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য, এবারের নারী দিবস তুলে ধরেছে নারী স্বাস্থ্য ও জাগরণের দিক। আমরা প্রত্যাশা করি, এমন একটি দিনের, যেদিন নারীকে তার অধিকারের জন্য আর লড়তে হবেনা, লড়তে হবেনা তার ন্যায্য দাবী আদায়ে। আমরা অপেক্ষমান সেই সময়ের জন্য যেসময়ে প্রতিটি দিনই উদযাপিত হবেন নারীরা।